সন্দেহে বেঁধে রেখে অমানুষিক নির্যাতন চালিয়েছে স্থানীয়রা বাগেরহাটের মোল্লাহাটে নিরীহ এক দিনমজুরকে চোর। নির্যাতনের দুটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে। গত শনিবার মোল্লাহাট উপজেলার গাংনী ইউনিয়নের ঘোষগাতি বাজারে ওই ঘটনা ঘটে।
আহত শেখ মনিরুজ্জামান উপজেলার পূর্ব দারিয়ালা গ্রামের প্রয়াত ইসলাম শেখের ছেলে। ভূমিহীন হওয়াতে গাংনী মাতারচর আশ্রয়ণ প্রকল্পে সরকারের দেওয়া একটি ঘরে থাকন তিনি।আমি বারে বারে হাতে পায়ে ধরে বলছি, আমারে মারার আগে একটু যাচাই করে নেও। আমি চোর না, কেই কোন কথাই শুনি নি। আমি শুধু শুধু মারছে।
নির্যাতনের শিকার দিনমজুর শেখ মনিরুজ্জামানকে (৪২) আহত অবস্থায় উদ্ধার করে মোল্লাহাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। তবে ঘটনায় তিন দিন পেরিয়ে গেলেও নির্যাতনে জড়িত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, ভ্যান থেকে নামিয়ে এক ব্যক্তি মনিরুজ্জামানকে ছাগল চোর আখ্যা দিয়ে একটি গামছা দিয়ে দুই হাত বাঁধছেন। এর মাঝেই আরও কয়েকজন এসে লাঠি দিয়ে মারতে মারতে তাকে মাটিতে শুয়িয়ে ফেলে। তখন বার বার কাঁদতে কাঁদতে তিনি চোর না বলে তাদের কাছে আকুতি করতে থাকনে। কিন্তু কিছুতেই কেউ তার কথা না শুনে মারতে থাকে। পরে কয়েকজন এসে তার পাও বেঁধে দেয়। অপর একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, আরও নির্মম ভাবে আঘাত করতে। বাঁধা অবস্থায় হাত, পা ও পিঠে আঘাত করতে করতে একজন হাপিয়ে গেলে আরেক জন এসে মারছেন। মার খেতে খেতে জ্ঞান হারালেও তাকে মারতে থাকনে তারা। যারা মারছিলেন পাশে থাকা ব্যক্তিরা তাদের উপুর করে, সোজা করে, পায়ে, তালুতে মার বলে নির্দেশনা দিতে শোনা যায়। জ্ঞান ফিরলে কয়েকজন জড় হয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন। তখন ছাগল চুরির পাশাপাশি এলাকায় গরুর চুরির ঘটনায়ও তাকে অভিযুক্ত করতে শোনা যায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত শনিবার মনিরুজ্জামানকে নিয়ে স্থানীয় মাতারচর এলাকার জনৈক জাহিদ তার অসুস্থ ছাগল নিয়ে চিকিৎসার জন্য উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ে যায়। সেখানে অসুস্থ ছাগলকে চিকিৎসা করিয়ে ভ্যান করে বাড়ি ফেরার পথে ঘোষগাতী গ্রামের কয়েকজন তাদের চোর সন্দেহে তাদের গতিরোধ করেন।
আহত শেখ মনিরুজ্জামান বলেন, ‘একটা ছাগলের বাচ্চা নিয়ে আমি আর আমার এক চাচা জাহিদ আসছিলাম মোল্লাহাট পশু হাসপাতালে। সেখান থেকে ট্রিটমেন্ট করায়ে ফিরে যাওয়ার পথে ছাগলের মালিক জাহিদ চাচাকে রানিং (ভ্যান চলন্ত) অবস্থায় একটা বাড়ি দেয়। ওই বাজারের ওখানে কয়েকজন আগে থেকে দাড়ানো ছিলেন। পরে আরও লোকজড় হয়। বাড়ি দিলে সে (জাহিদ) দৌড় দেয়। তখন তারা বলে সে চুরি করে নিয়ে পলাচ্ছে। পরে লোকজন জড় হলে আমারে মারধর করে। আমি কাজ করি। আমাকে মিথ্যে চোরের অভিযোগ দিয়ে প্রচুর মারিছে। মারতি মারতি অনেকগুলো লাঠি ভাঙিছে আমার গায়। আমি জ্ঞান হারায় ফেলে ছিলাম। সেখানে লোক ছিল প্রচুর, প্রায় ৪০-৫০ জন। কিন্তু মারছে তিন চারজনে। সবাইরে চিনি না। একজন ছিল ওয়ার্কসপের কাজ করে মাহামুদ নাম।
সেদিন ওই বাজারে মনিরুজ্জামানকে মারধরে ঘটনায় জড়িত কারো বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি। তবে স্থানীয় দুই যুবক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এলাকায় গরু চুরি বেড়েছে। এ বিষয়ে থানা পুলিশে অভিযোগ করেও কোন সুরাহা হয়না। তাই মানুষ আইন হাতে তুলে নিচ্ছে।
তবে একটি সূত্র বলছে বিশ হাজার টাকা দেওয়ার আশ্বাস এবং ভয়ভীতি দেখিয়ে পরিবারটিকে মামলা করা থেকে বিরত রাখা হয়।
মোল্লাহাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. নাহিদুল ইসলাম বলেন, গণপিটুনির শিকার এক ব্যক্তিকে গত শনিবার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার শরীর ছুড়ে আঘাতের চিহ্ন আছে। তবে কোথাও ক্ষত নেই। সবই ব্লাংক হুইপেনের (লাঠিজাতীয় কিছু) আঘাত। উন্নত চিকিৎসার জন্য মঙ্গলবার তাকে গোপালগঞ্জ হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়েছে।
এ বিষয়ে মোল্লাহাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সোমেন দাস মুঠোফোনে বলেন, ঘটনা জানার পর উভয় পক্ষকে থানায় ডাকা হয়। তাদের দাবী এটি ভুল বুঝাবুঝি। ভুক্তভোগী পরিবার মামলা করবে কিনা জানতে চাইলে তারা আর্থিক সমস্যার কথা বলে মামলা করবেন না জানান। এছাড়া তারা কোনো অভিযোগ নেই মর্মে লিখিত দিয়েছেন। বিষয়টি মিমাংসা হয়ে গেছে।
পত্রিকা একাত্তর/ আবু তালেব
আপনার মতামত লিখুন :