প্রাপকের ঠিকানা অনুযারী কেবল চিঠি পৌঁছে দেওয়া নয়, মানুষও পৌঁছে দেন পোস্টম্যানরা। এক মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তিকে ৩২ বছর পর তার স্বজনদের কাছে পৌঁছে দিয়ে উদার মানসিকতার অনবদ্য এক কৃতিত্ব দেখালেন নীলফামারীর ডোমার উপজেলা পোস্ট অফিসের বোড়াগাড়ি শাখার পোস্টম্যান হোসেন আলী।
বৃহস্পতিবার (৬ই জানুয়ারি) দুপুরে স্বজনদের ফিরে পান জিয়াউল হক (৬২)। পরিবার ফিরে পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি। তাকে ফিরে পেয়ে স্বজনরাও আবেগে ভাসেন। আর যে ব্যক্তির প্রচেষ্টায় এই অভাবনীয় ঘটনা ঘটলো, সেই হোসেন আলীকে হৃদয়ের গভীর থেকে ভালোবাসা জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
পিরোজপুর জেলার ৩নং দূর্গাপুর ইউনিয়নের মরহুম আলহাজ্ব মোক্তাদের আলী মাঝির পুত্র জিয়াউল হক। প্রায় ৩২ বছর আগে নীলফামারীর ডোমার উপজেলায় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল দপ্তরের টাইপিস্ট পদে বদলি হয় তার। প্রায় সাড়ে পাঁচশো কিলোমিটার দূরে গিয়ে চাকরি না করার অনুরোধ করেন তার স্ত্রী। কিন্তু কোনোভাবেই চাকরি ছাড়তে চাননি জিয়াউল। এ নিয়ে মতানৈক্যে অশান্তি লাগে সংসারে। দুই মেয়ে ও ছেলেকে নিয়ে জিয়াউলকে ছেড়ে চলে যান স্ত্রী। পরে বিচ্ছেদ। তারপর থেকে জিয়াউল হক পরিবারের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখেননি।
ডোমারে নিজ অফিসের কাজে মনোযোগী হন। তার খোঁজও কেউ নেননি। এভাবেই চলছিল। তবে পরিবার হারিয়ে কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয় তার। প্রায় ২০ বছর আগে এ কারণেই চাকরি হারান তিনি। চাকরি ফেরত পেতে বিভিন্ন দপ্তরে ঘোরাফেরা করেও কোনো লাভ হয়নি। একসময় একেবারেই ভেঙে পড়েন। মানসিকভাবে পুরোপুরি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। পরিবার আগেই হারিয়েছেন, তারপর চাকরি, সবশেষে হারালেন মানসিক ভারসাম্য।
বেঁচে থাকার তাগিদে এক সময় ভিক্ষা করা শুরু করেন। ভিক্ষুক হলেও পিতৃত্ব হারাননি। ভিক্ষার টাকা জমিয়ে দুই মেয়ে ও ছেলেকে টাকা পাঠানো শুরু করেন তিনি। পিরোজপুরের জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, ইউএনও, ওসিসহ বিভিন্ন কর্মকর্তার নামে টাকা পাঠাতেন। টাকার অংকও খুব বেশি না। ২০০ বা ৩০০ করে। ডোমার পোস্ট অফিস থেকে ৪০ থেকে ৫০টি মানি অর্ডার করেন তিনি। এদিকে মানি অর্ডারের কারণ না জেনে কোনো কর্মকর্তা টাকা গ্রহণ করতেন না। তাই তার পাঠানো সমস্ত টাকা আবার ফেরত চলে আসতো ডোমারেই। এজন্য তিনি প্রতিদিন ডোমার পোস্ট অফিসে যাতায়াত করতেন।
পোস্টম্যান হোসেন আলী বলেন, জিয়াউল হক চাচা ডোমার পোস্ট অফিসে এসে রেগুলার মানি অর্ডার করতেন। তবে তার পাঠানো সমস্ত টাকা আবার ফেরত চলে আসতো। তিনি প্রতিদিন অফিসে এসে খোঁজ নিতেন, তার পরিবারের কেউ টাকা পেয়েছে কি না। এভাবে তিনি প্রায় ২০ বছর ধরে পোস্ট অফিসে যাতায়াত করেছেন। আমি কয়েকদিন আগে তার কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে পিরোজপুরের বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপে উনার ছবিসহ পোস্ট দেই। তবে কোনো কাজ হয় না। তারপর সৌরভ নামের পিরোজপুরের এক পোস্টম্যানের সহায়তায় তার পরিবারের সন্ধান পাই। উনার ছেলে সহিদুল ইসলাম সজিবের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ হয়। পরে সজিব ডোমারে এসে বাবাকে নিয়ে যান।
বহুদিন পর বাবাকে ফিরে পেয়ে সহিদুল ইসলাম সজিব বলেন, আমার বয়স যখন দেড় বছর, তখন বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হয়। বাবা ডোমার চলে আসেন। আমার বড় দুই বোন ও আমি নানার বাড়িতেই থাকি। তখন থেকেই বাবা নিখোঁজ ছিলেন। গত বুধবার সকালে যখন ডোমার পোস্ট অফিস থেকে হোসেন ভাই ফোন করে বলেন, আপনার বাবা ডোমারে আছে। তাকে নিয়ে যান। তখন আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছি। সঙ্গে সঙ্গে আমরা রওনা হই। জীবনে প্রথম বাবা দেখলাম। জড়িয়ে ধরলাম। এরকম শান্তি আর কখনো পাইনি।
মানসিক ভারসাম্য হারালেও যে মানুষটি সন্তানদের ভোলেননি, সন্তানদের কাছে পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি। ধরা গলায় তিনি বলেন, ‘৩২ বছর পর ছেলে-মেয়েদের কাছে পেলাম। খুব ভালো লাগছে। যে চাকরির জন্য পরিবার-পরিজন হারিয়েছি, এখন সেই চাকরিটাও নেই। সরকারের আমার চলে যাওয়া চাকরিটা ফেরত দেওয়ার দাবি জানাই।
অভিমান, রাগ বা কোনো ভুল সিদ্ধান্তের কারণে কাছের মানুষ দূরে চলে যেতে পারে। তার প্রভাব চরমভাবে পড়তে পারে ব্যক্তি জীবনে। আর তাতে সামাজিক, পারিবারিক বা ব্যক্তিগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে মানুষ। জিয়াউল হক তার জলজ্যান্ত উদাহরণ। তবে অবশেষে তিনি ফিরতে পেরেছেন স্বজনদের কাছে।