উত্তর জনপদের বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর, নীলফামারী ও বগুড়া জেলার অনাবাদিতে জমিতে সেচ সুবিধা দেওয়ার প্রেক্ষিতে, ১৯৭৯ সালে লালমনিরহাট জেলার হাতিবান্ধা থানার দোয়ানি নামক স্থানে এবং ডিমলা থানার, নীলফামারী জেলার ডালিয়া পয়েন্ট নামক স্থানে ৫২ টা গেটের সম্বনয়ে তিস্তা ব্যারেজের কাজ শুরু হয়। যা দেশের বৃহৎ সেচ প্রকল্প নামে পরিচিত।
১৯৯০ সালে গেটের উদ্ভোধন হয়। যা উত্তর জনপদের মানুষের কাছে আশীর্বাদ রুপে রুপান্তর হয়।অনাবাদি জমিতে ধান, ভুট্টা,বাদাম, পিয়াজ,পাট প্রায় সব ধরনের ফসল উৎপাদনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হয় এবং দারিদ্রতার হ্রাস পায়, এছাড়া অনেক প্রকার মাছ সেখানে পাওয়া যায়,বিখ্যাত এবং সুস্বাধু বইরাল মাছ তিস্তায় পাওয়া যায়। মাছ কে কেন্দ্র করে অসংখ্য মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে, জীব বৈচিত্র এর ভারসাম্য রাখতে তিস্তা অবদান রাখে।তিস্তা নদী বাংলাদেশ-ভারতের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী। এটি ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ও বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত একটি নদী। তিস্তা সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি বিভাগের প্রধান নদী। একে সিকিম ও উত্তরবঙ্গের জীবনরেখাও বলা হয়। সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার পর বাংলাদেশে প্রবেশ করে তিস্তা ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে মিলিত হয়েছে।
বাংলাদেশে অবস্থিত ১১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদীর পানিকে সেচ সুবিধার দেওয়ার জন্য ৭১২ কিলোমিটার ক্যানেল তৈরি করা হয়।যা দিয়ে ৬ লক্ষ হেক্টর জমিকে আবাদযোগ্য করা হয়। যা দেশের খাদ্য চাহিদায় স্বয়ংসম্পুর্ন হতে প্রত্যক্ষভাবে অবদান রাখে।তিস্তা নদীর সাথে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে কয়েক কোটি মানুষ জড়িত। তবে দুর্ভাগ্যক্রমে তিস্তা নদী নিয়ে এখন পর্যন্ত কোন যথাযথ পদক্ষেপ এর বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।তিস্তা নদীর পানি নিয়ে প্রথম চুক্তি সম্পন্ন হয় বাংলাদেশ স্বাধীনের পর পরই ১৯৭২ সালে তিস্তার পানি নিয়ে যৌথ নদী কমিশনের দ্বিতীয় সভায় আলোচনা হয়।
১৯৮৩ সালে অন্তর্বর্তীকালীন একটি চুক্তিও হয়েছিল। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশের ছিল ৩৬ শতাংশ, ভারত ৩৯ শতাংশ আর ২৫ শতাংশ পানি ছিল নদীর নাব্যতা বজায় রাখার জন্য। ১৯৮৫ সালে সেই অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়। এর পর ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর উভয় দেশের নেতৃত্ব নতুন দিল্লিতে মিলিত হয়ে একটি ৩০ বছরের সামগ্রিক চুক্তি সাক্ষর করেন। এই চুক্তি অনুযায়ী ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মে পর্যন্ত ফারাক্কা থেকে দুই দেশের মধ্যে জল বণ্টন করা হতে থাকে। পূর্ববর্তী ৪০ বছরের গড় মাত্রা অনুযায়ী ভারত গঙ্গার জলের ভাগ পেতে থাকে।তবে চুক্তির মেয়াদ শেষ হবার আগেই তারা বাংলাদেশে পানি দেয়না। বর্ষা মৌসুমে যখন তারা পানি নিয়ন্ত্রন রাখতে পারে না তখন বাংলাদেশে পানি ছেড়ে দেয় যা সৃষ্টি করে বন্যার এবং ক্ষতিগ্রস্থ করে কয়েকশ কোটি টাকার সম্পদ।
তারপর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চেষ্টায় ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ঢাকা সফর করেন। সে সময় তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরের কথা ছিল। অন্তর্বর্তীকালীন সেই চুক্তি সময়কাল ধরা হয়েছিল ১৫ বছর। এ চুক্তি অনুসারে তিস্তা নদীর পানির ৪২.৫ শতাংশে ভারতের অধিকার ও ৩৭.৫ শতাংশ বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতার কারণে চুক্তিটি সম্পন্ন হয়নি।পরবর্তী সময়ে ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফর করেন। তার ভারত সফরকে ঘিরে আশা তৈরি হয় তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরের। সফরে তিনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠক করেন। কিন্তু তখন ও সম্মতি জানাননি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী।
তিস্তা নদীর উজানে ভারতীয় অংশে, গজলডোবা বাঁধের (ব্যারাজ) মাধ্যমে তিস্তা নদীর নিয়ন্ত্রণ ভারতের হাতে চলে গেছে, ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে তিস্তা নদীর বাংলাদেশ সীমান্তের ৬০ কিলোমিটার উজানে ভারত সরকার এই বাঁধ নির্মাণ করে। এই বাধ নির্মানের আগে তিস্তা অববাহিকায় ২৫০০ কিউসেফ পানি পাওয়া যেত। যা এখন ৪০০ কিউসেফের ও কম। যার ফলে আশিবাদ তিস্তা দিন দিন অভিশাপে পরিনত হচ্ছে, মানুষের জীবন স্থবির হয়ে যাচ্ছে। শীতের আগেই এটি ধারন করতেছে ধুধু মরুভুমিতে। এলাকার মানুষের জীবন ও জীবিকার বড় প্রতিপক্ষ হয়ে হয়ে উঠতেছে তিস্তা নদী। তিস্তা নদীর দীর্ঘ ইতিহাসে আজ অব্দি তা খনন করা হয়নি। ফলে নদীর নাব্যতা হারিয়ে গেছে, এবং প্রতিবছর বন্যায় চারপাশের জমি তলিয়ে যাওয়াতে তার গভীরতা কমে যেয়ে এখন ব্যারেজের কপাট এর সমান হয়ে গেছে, নদীতে নেই গভীরতা রয়েছে শুধু বালু আর বালু। যার ফলে বর্ষা মৌসুমে অল্প বৃষ্টির পানি আর ভারতের উদ্ধত্ত জলরাশিতেই প্রতিবছর ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কয়েকশত কোটি টাকার সম্পদ তিস্তা প্রকল্পে যদি পুরো নদি খনন করা হয়, কমপক্ষে ১০ মিটার গভীরতা বানানো হয়।
উদ্ধত জলরাশিকে সংরক্ষণ এর জন্য জলাধার নির্মান করা হয় এবং শুষ্ক মৌসুমে সেচের মাধ্যমে তার ব্যবহার করা,তবে উত্তরবঙ্গ মরুভুমি হওয়া থেকে বেচে যাবে।জীবন যাত্রার মান বাড়বে, জিডিপি তে যা প্রভাব ফেলবে।
এছাড়া ব্যারেজের দু পাশে ব্যাপক শিল্পায়ন ও নগরায়ন এর অপার সম্ভবনা রয়েছে। গড়ে উঠতেছে বিনোদন স্পট, পার্ক রেস্টুরেন্ট। রয়েছে অবসর এবং কন্ট্রোলরুম,গড়ে উঠতেছে ব্যাটালিয়ন ক্যাম্প, প্যারাগোন কোম্পানী এবং সোলার কোম্পানী। তাছাড়া বুড়িমারী স্থলবন্দর থেকে বিভাগীয় শহর রংপুর এবং রাজধানীর ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা হবে আরো সহজ। যা দেশের উন্নয়নে ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করবে। এজন্য বলা যায় যদি তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায় হয় তবে পদ্মাসেতুর ন্যায় অন্যন্য এক অর্জন হবে তা।
পত্রিকা একাত্তর/ রবিউল ইসলাম
আপনার মতামত লিখুন :