সন্তান জন্মদানে সারোগেসি পদ্ধতি, আসলেই কি মাতৃত্বের স্বাদ পাচ্ছেন মায়েরা?

পত্রিকা একাত্তর

পত্রিকা একাত্তর

২৬ জানুয়ারী, ২০২২, ৩ years আগে

সন্তান জন্মদানে সারোগেসি পদ্ধতি, আসলেই কি মাতৃত্বের স্বাদ পাচ্ছেন মায়েরা?
নয়ন কুমার বর্মন | মতামত - পত্রিকা একাত্তর

মা শব্দটি পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান কয়েকটি শব্দের মধ্যে একটি। সারোগেসি শব্দটি এখন বহুল প্রচলিত শব্দের মধ্যে একটি এবং সারোগেসি শব্দটি মূলত সন্তান ধারণ করার একটি বিকল্প পদ্ধতি বা মেডিকেল সাইন্স এর একটি বিশেষ উপায় এর সন্ধান। পৃথিবীর সমস্ত দম্পতি তাদের ঔরসজাত সন্তান প্রাপ্তির জন্য জাগতিক জীবনে সমস্ত পদ্ধতি অবলম্বন করে চেষ্টা করে থাকেন। কেউ কেউ সফল হন, কেউ কেউ আবার শারীরিক সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতার কারণে সন্তান ধারণে অক্ষম হন এবং তার সাথে সাথে মা ডাকের জন্য বা মা হওয়ার জন্য যোগ্যতা হারান।

একজন বিবাহিত বা অবিবাহিত নারী যখন তার গর্ভে অন্য আরেক দম্পতির সন্তান ধারণ করে এবং তাকে প্রসব করেন তখন সেই পদ্ধতিকে মূলত সারোগেসি পদ্ধতি বলা হয়। সারোগেসির এই পদ্ধতি বেশ দীর্ঘকালীন। সারোগেসি পদ্ধতিতে মূলত একজন দম্পতি যখন তার সন্তান ধারণ করার জন্য সারোগেট মাদার কে পছন্দ করেন এবং সারোগেসি পদ্ধতিতে যাবতীয় সকল রুলস রেগুলেশন ফলো করে সারোগেসি পদ্ধতিতে পিতা-মাতা হওয়ার সুযোগ নেন তখন দম্পতি পুরুষের শুক্রাণু এবং নারীর ডিম্বানুর আলাদাভাবে করে সংগ্রহ করে বাইরের নিষিক্তকরণ প্রক্রিয়া এর মাধ্যমেই যখন সারোগেট মাদার এর গর্ভে ধারণ করা হয় তখন সেই পদ্ধতিই হচ্ছে সারোগেসি।

বর্তমানে সারোগেসি পদ্ধতি শুধুমাত্র যারা সন্তান ধারনে অক্ষম তারাই কিন্তু এই পদ্ধতি ব্যবহার করে না। অনেক আছে অনীহার কারনে নিজে সন্তান গর্ভধারন না করে টাকার বিনিময়ে গর্ভ ভাড়া করে সারোগেসি পদ্ধতিতে মা হচ্ছেন। এছাড়াও অনেক কারনেই মানুষ সারোগেট বেবি নিয়ে থাকেন, যেমন- সন্তান ধারনের কষ্ট সহ্য না করার ইচ্ছা, ব্যস্ততার কারনে বা শারীরিক সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়ে, বিয়ে না করে সিংগেল মাদার হওয়ার ইচ্ছা, ইত্যাদি নানা কারনে মানুষ সারোগেট বেবি নিয়ে থাকেন। এই বিষয়টা লক্ষ করা হয় ধ্বনী পরিবার গুলোতে বিশেষ করে টাকাওয়ালা দম্পতিরা সন্তান ধারনে সক্ষম হয়েও নানান কারনে তারা সারোগেসি এর দিকে ঝুকছে দিন দিন। এধনের সারগেট বেবি নেওয়ার প্রবণতা ইন্ডিয়ায় কয়েক বছর আগেও ব্যপক জনপ্রিয় ছিল।

শাহরুখ খান, আমির খান তাদের একাধিক সন্তান থাকার পরেও সারোগেট বেবি নিয়েছেন, এদিকে আবার বিয়ে না করেই করণ জোহার, তুষার কাপুড়, একতা কাপুড় এবং আরো অনেকেই সারোগেট বেবি নিয়েছেন। সম্প্রতী বলিউডের জনপ্রিয় নায়িকা প্রিয়ঙ্কা চোপড়া ও নিক জোনাস জুটি সারোগেসি পদ্ধতিতে কন্যা সন্তানের অভিভাবক হয়েছেন। এতে করে, আসলেই কি মাতৃত্বের স্বাদটা পাচ্ছে সেসব মায়েরা। যদিও পিতা মাতার শুক্রাণু ও ডিম্বানুর নিষিক্তকরণে তৈরী জাইগোট থেকে সন্তান টি জন্মগ্রহণ করে তারপরও তারা পুরো পুরি পিতা মাতা হওয়ার স্বাদটা সেসব পিতা মাতারা পায় কি? আগেকার সময়ে একটি সন্তান জন্মদানের জন্য কতো প্রকার আয়োজন অনুষ্টান করা হতো,তার অর্ধেকাংশ এখন আর হয়না। একটি সন্তান জন্মদানে ১০ মাস ১০ দিন সময় একটি মায়ের কষ্টের কাটলে ও সন্তান প্রসব করার পর সেই মা সমস্ত দু:খ কষ্ঠ ভুলে যায় মূহর্তের মধ্যেই। যা একটা অন্যরকম আনন্দ অনুভূতি,ভালোবাসার জন্ম দেও নতুন সন্তান জন্মদানের সঙ্গে সঙ্গে।

অপরপক্ষে যে মায়েরা সন্তান জন্মদানে সক্ষম হয়েও অন্যের গর্ভ ভাড়া করে সন্তানের মাতৃত্ব লাভ করতে চায় তাহারা কিন্তু সাধারণ মায়েদের মতো সেই অনুভূতিটা পায় না। পায় না আসল মাতৃত্বের স্বাদ গ্রহণ করতে, তারা কখনো বুঝতেই পারে না মা হওয়ার কষ্ঠ ও বেদনার কথা। মা একটি বিশাল শব্দ এবং এটি অনেক বৃহৎ একটি অর্থ বহন করে যেখানে সন্তানের প্রতি স্নেহ, মায়া, মমতা ও ভালোবাসার কথা উদ্ধৃত আছে। সুতরাং সারোগেসি পদ্ধতিতে মা হলে কোনো মতেই আসল মাতৃত্বের স্বাদ গ্রহণ করতে পারে না তারা। এটি অনেক বড় একটি ব্যর্থতা সেসব দম্পতির, যারা এই পদ্ধতিটা ব্যবহার করে পিতা মাতা হয়েছে। যদিও সেসব সন্তান কোনোদিন জানতেই পারবে না কার উদরে তার জন্ম, যদি পিতা মাতা এসব সন্তানদের কোনোদিন না বলে ততদিন রহস্য হয়ে থাকবে এবং চিরদিন তারা সন্তানদের কাছে অপরাধী হয়ে থাকে। এভাবে দম্পতিরা যদি পিতা মাতার স্বাদ গ্রহন করতে থাকে তাহলে মা নামক এই বিশাল শব্দকে অপমান করা হবে।

সারোগেসি দুই রকমের হয়-

  • ১. পার্শিয়াল সারোগেসি- অনেকদিন থেকে এটি চলছে। সন্তান ধারণে এখানে কোনও ভূমিকাই পালন করেন না মা। বাবার শুক্রাণু আর সারোগেট মায়ের ডিম্বাণু থেকে শিশুর জন্ম হয়।
  • ২. ট্রু-সারোগেসি/জেস্টেশনাল/আইভিএফ সারোগেসি- মায়ের ডিম্বাণু নিয়ে ল্যাবে ভ্রূণ তৈরি করা হয়। এরপর সারোগেট মায়ের জরায়ুতে প্রতিস্থাপন করা হয় ভ্রূণটি। এটিই এখন প্রচলিত পদ্ধতি।
পার্শিয়াল সারোগেসি পদ্ধতিতে মহিলার ডিম্বাণু এবং গর্ভ দুটোই ভাড়া নেয়া হয়। সেক্ষেত্রে সন্তানের ওপর মায়ের একটা জৈবিক অধিকার থেকে যায়। অন্যদিকে আইভিএফে মায়ের ডিম্বাণু ‘স্পার্ম ব্যাংকদ থেকে আনা অন্য পুরুষের শুক্রাণুর সঙ্গে অথবা বাবার শুক্রাণু ডোনার মহিলার ডিম্বাণু দেহের বাইরে নিষিক্ত করে ভাড়া দেয়া মহিলার গর্ভে প্রতিস্থাপন করা হয়। যেহেতু গর্ভ ভাড়া দেওয়া মহিলার ডিম্বাণু ব্যবহার করা হয়নি, সেহেতু ভূমিষ্ট সন্তানের ওপর সেই মহিলার কোনো অধিকার থাকে না। তবে বাবা-মায়ের শুক্রাণু এবং ডিম্বাণু নিষিক্ত করে যে ভ্রুণ তৈরি করা হয়, তার পিতৃত্ব বা মাতৃত্ব নিয়ে কোনো সংশয় থাকে না। তবে আইভিএফ পদ্ধতিতে ডিম্বাণু ও শুক্রাণু নিষিক্ত করাকে টেস্ট-টিউব বেবি মনে করা যাবে না। কারণ টেস্ট-টিউব বেবি ভ্রুণ অবস্থায় মাতৃগর্ভেই বেড়ে ওঠে।

ইসলামিক আইনে সারোগেসি, ইসলামিক আইনে টেস্টটিউব বেবি হালাল হলেও, সারগেছি হারাম। ইসলামী স্কলারদের মতে, এই জাতীয় সারোগেট মাতৃত্বের অনুমতি নেই কারণ এটি জিনা (ব্যভিচার) এর সমতুল্য, যেহেতু সারোগেট তার বৈধ স্বামী নয় এমন ব্যক্তির নিষিক্ত ডিম বহন করে। যে সন্তানের জন্ম হয়, বৈধ বিবাহের মাধ্যমে তার কোন বংশগত সম্পর্ক নেই, এই কারনে সন্তানটি অবৈধ বলে গন্য হবে। যেহেতু সন্তানটি অবৈধ, সেহেতু এই পদ্ধতি অর্থ্যাৎ সারোগেছি কে হারাম বলা হয়েছে। ১১ থেকে ১৬ ই অক্টোবর ১৯৮৬ সালে, জর্ডানের রাজধানী আম্মানে ইসলামিক ফিকহ একাডেমি কাউন্সিলের তৃতীয় অধিবেশনে ঘোষনা করা হয় যে, সারোগেছি ইসলামে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ।

অপরদিকে হিন্দু আইনে, পুরোহিতদের মতে সারোগেট মাতৃত্বের অনুমতি নেই কারণ এটি অবৈধ সম্পর্কের সমতুল্য, যেহেতু সারোগেট তার বৈধ স্বামী নয় এমন ব্যক্তির নিষিক্ত ডিম বহন করে। যে সন্তানের জন্ম হয়, বৈধ বিবাহের মাধ্যমে তার কোন বংশগত সম্পর্ক নেই, এই কারনে সন্তানটি অবৈধ বলে গন্য হবে। যার কারনে হিন্দু ধর্মেও এটাকে বড় পাপের সঙ্গে তুলনা কর হয়।

বাংলাদেশে সারোগেসি: বাংলাদেশ একটি মুসলিম মেজরিটি কান্ট্রি হওয়ায় এখানে টেস্টটিউব বেবি আইনগত ভাবে বৈধ হলেও, সারোগেসির বিষয়টি এখনও আইনগত ভাবে বৈধতা পায় নি।কিন্তু জার্মান ভিত্তিক সংবাদপত্র ডয়েচেভেলের বরাত দিয়ে জানা যায় বাংলাদেশে গোপনে গোপনে সারগেসি চলে বলে ধারণা করা হয়।বাংলাদেশে নিঃসন্তান দম্পতির সংখ্যা শতকরা ১৫ ভাগ বলে সাধারণভাবে ধরে নেয়া হয়, যদিও এ ব্যাপারে কোন সঠিক জরিপ নেই।ফাইন্ড সারোগেট মাদার নামক এই ওয়েব সাইটে দেখা যাচ্ছে অনেক বাংলাদেশিই সারগেট হওয়ার জন্য, আবার অনেকে সারোগেট ভাড়া নেওয়ার জন্য এড দিয়ে রেখেছেন। অপরপক্ষে গোপন ওয়েবসাইটে তথ্য মতে বাংলাদেশের- ঢাকায় দুইটি এবং চিটাগং এ একটি প্রাইভেট হসপিটাল সারোগেছি সেন্টার হিসাবে লিস্টেড রয়েছে। এদের মধ্যে একটি ১০ লাখ, একটি ১৪ লাখ এবং একটি ১৫ লাখ ৯০ হাজার টাকা সারোগেছি খরচ দিয়ে রেখেছে উক্ত হাসপাতাল গুলো।

ভারতে কমার্শিয়াল সারোগেসি: বানিজ্যিক সারোগেসিতে একটা নিদৃষ্ট পরিমান অর্থের বিনিময়ে একজন মা তার নিজের গর্ভে অন্য একজনের সন্তান ধারন করেন। এ ক্ষেত্রে সারোগেট মাদার পান অর্থ এবং ইন্টেনডেড প্যারেন্টস্ পান সন্তান। ২০০৫ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ভারত ছিল কমার্শিয়াল সারোগেসির হটস্পট, সারগেছি বিল ২০১৬ পাশ হবার পর বানিজ্যিক সারোগেসি নিষিদ্ধ হয়ে গেছে তবে আলটুরিস্টিক সারোগেসি চালু আছে। এছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বানিজ্যিক সারোগেছি প্রচলিত আছে, আবার অনেক দেশেই এটা অবৈধ।

পত্রিকা একাত্তর/নয়ন কুমার বর্মন

ভিডিও দেখতে সাবস্ক্রাইব করুন

youtube
Patrika71.com
news